শ্বেত শুভ্র হিমালয়ের মায়াবী ইন্দ্রজাল, নরম সবুজের আলোয়ানে মোড়া প্রশান্তি, নব্য কিশোরীর প্রাণোচ্ছলতা নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা দুরন্ত ঝর্ণা। হ্যাঁ আমাদের আজকের গন্তব্য "দি কুইন অফ দা হিলস" দার্জিলিং এ।
দার্জিলিংয়ের নামটি এসেছে দুটি শব্দ দোরজে ও লিং থেকে। তিব্বতি ভাষায় দেবরাজ ইন্দ্রর বজ্রের নাম দোরজে এবং লিং এর অর্থ স্থান। নামকরণের সূত্র ধরে দার্জিলিং কে বলা যায় ল্যান্ড অফ থান্ডার বল্টস বা বজ্রপাতের ভুমি। নামকরণের পিছনে যাই কারণ থাকুক আজকের দার্জিলিং শুধুই রূপসী, পাহাড় রানী রঙে রঙে ভরা।
ফাগুনের রঙ ছড়ানো রডোডেনড্রন, উজ্জ্বল সাদা ম্যাগনোলিয়া, উঁচু-নিচু পথ ধরে মাইলের পর মাইল পান্না সবুজ চা বাগান, রূপালী ফারের বন, প্রথম সূর্যালোকের স্পর্শে সোনার রঙে মোড়া বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং সব কিছুই পরিপাটি করে সাজানো দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের নীচে। তাই এক কালে সিকিম রাজার অধীনে থাকা এই শহরটিকে ১৮৩৫ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিগ্রহণ করেন তখন থেকেই ব্রিটিশদেরও সর্ব প্রিয় সামার ক্যাপিটাল হয়ে ওঠে দার্জিলিং।
শহরটি ছোট হলেও দেখার জায়গা আছে অনেক। ভোর রাতেই বেড়িয়ে পড়ুন টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে। উপভোগ করুন আলো-আঁধারি আকাশে সূর্যোদয়ের ঠিক প্রাকমুহুর্তে কেমন করে আকাশ ফুঁড়ে জেগে ওঠে গা ছমছমে কালীয়নাগের মত কাঞ্চনজঙ্ঘার পঞ্চ শিখর। সূর্যের আলো পড়তেই সব ভয়ংকরতা দূর হয়ে যায় এক নিমেষে। ভয়ংকরী কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন রানীর মত পরমা সুন্দরী
তার রাজকীয় সাদা মুকুটের প্রজ্বল দীপ্তিতে।
এরপর সরাসরি নেমে আসা বাতাসিয়া লুপে। এখানেই ইউএনও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর শিরোপায় ভূষিত ছোট্ট টয় ট্রেনটি মেঘের মত ইঞ্জিনের ধোঁয়া উড়িয়ে তার হুইসেলের আওয়াজের মাদকতা ছড়িয়ে বাঁক নেয় স্বপ্নালু সুসজ্জিত বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা নিহত গোর্খা সেনাদের ওয়ার মেমোরিয়াল এর ধার দিয়ে। স্বপ্নের দেশে বীর সেনানীদের জন্য এ যেন এক অনন্য গার্ড অফ অনার।
বাতাসীয়া লুপে আপনার বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে আসুন আরো একটি শ্রদ্ধা বিজরিত স্থান ঘুম মনাস্ট্রিতে। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামির পবিত্র সুরে ভরে উঠুক আপনার সকাল।
পাহাড়ের বুকে চোখ রেখে ক্যাভেন্টারস এর রুফটপে বসে সেরে নিন রোমান্টিকতায় মোড়া ইংলিশ ব্রেকফাস্ট। দিনভর ঘোরার জন্য আছে জাপানিজ টেম্পল, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, দার্জিলিং জু, টিবেটিয়ান রিফিউজি সেল্ফ হেল্প সেন্টার,তেনজিং এন্ড গম্বু রক, রোপ ওয়ে, লেবন রেসকোর্স, গোর্খা ফুটবল স্টেডিয়াম, লালকুঠি, বিরহাম টেম্পেল। এর প্রত্যেকটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ। এবং তাই তো পর্যটকরা বারবার দার্জিলিং ঘুড়তে এসেও এগুলো দেখতে ছুটে যান।
দার্জিলিং মানেই চায়ের কাপে বিশ্ববন্দিত স্বাদ। এখানে এলে আপনাকে তাই যেতেই হবে রঙ্গীত ভ্যালি টি গার্ডেন, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেটের মতন চা বাগান গুলিতে। মন ভেজাতে হবে সেরা চায়ের চুমুকে।
পড়ন্ত বিকেলে চলে আসুন ম্যাল রোডে। এখানে উদ্দেশ্যহীন ভাবে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াবার বা চুপ করে বেঞ্চের এক কোণে বসে থাকার মজাটাই আলাদা। এছাড়াও ম্যালকে ঘিরে সারি সারি আঞ্চলিক তিব্বতি, নেপালি হস্তশিল্পে সহ নানান জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা দোকান থেকে কেনাকটা করাটাও দারুণ উপভোগ্য। এছাড়াও আপনি বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে গরম কফি ও নরম স্যান্ডউইচের অভূতপূর্ব যুগলবন্দীর রসনায় মজে অনায়াসে কাটাতে পারেন নার্দভানা ক্যফেতে।
দিনের শেষে ডিনার সারতে ঢুকে পড়ুন তিব্বতি খাবারের সেরা ঠিকানা দেকেভাস বা কুঙ্গার মত কোন একটি রেস্টুরেন্টে।
দার্জিলিং আসার সেরা সময় বলে কিছু হয় না। বিভিন্ন ঋতুতে দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন রুপ এবং প্রত্যেকটিই অদ্বিতীয়। মাত্র একবারই দার্জিলিং এসেছে এমন পর্যটক খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। এখানে মানুষ হাতে সময় থাকলেই ছুটে আসেন প্রতিবার এই মেঘরাজ্যের থেকে নতুন কিছু নিয়ে ফিরে যান। যারা এখনো আসেননি আর দেরি করবেন না, একবার ঘুরে স্বচক্ষে দেখে যান পাহাড়ের রানিকে। একবার দেখলেই আপনিও বারে বারে আসতে চাইবেন দার্জিলিং...© 2021, Easy Eco Tour. All rights reserved.
Comments